ভারত মহাসাগরের পশ্চিমভাগে একই রকম ব্যাপার ঘটছিল, কারণ ভারতীয়রা রোমান সাম্রাজ্যের সাথেও বাণিজ্য করতে শুরু করেছিল, এবং এই রোমান সাম্রাজ্যের গোড়ার কথা এবং সেই সময় কী কী ঘটছিল সে সব লিখে রাখা হয়েছে “দ্য পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সী” নামের একটি পুস্তকে। এই একটি আকর্ষণীয় পুস্তক। এটি গ্রীকে লেখা, একটি গ্রীক-মিশরীয় পুস্তক এবং এটি আমাদের স্পষ্ট জানায় কোন্ পথে রোমান সাম্রাজ্যের বণিকরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতে আসতেন।
তাহলে এর শুরুকোথায় হ’ত? দুটি জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করা হ’ত, হয় আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে নয়তো টায়ার অথবা সিডন থেকে শুরু করা যেত। আলেক্সান্দ্রিয়ায় যাত্রা শুরু করা হ’লে নীলনদ ধ’রে স্রোতের অভিমুখে কিছুদূর বয়ে গিয়েএবং তারপরে একটি খাল পড়ত যা কিনা সত্যিই নীলনদকে বর্তমান কায়রোকে যে অঞ্চলে এখন সুয়েজ খাল রয়েছে তার কাছাকাছি একটি স্থানের সঙ্গে যুক্ত করত। অতএব আপনারা আজকের দিনে যে সুয়েজ খাল দেখতে পান সেটিসুয়েজের আদিরূপ নয়, হাজার হাজার বছর আগেও একটি খাল ছিল। অবশ্যই যে সমস্যাটি ছিল তা হ’ল এই এলাকা বালুকাময়, ফলে একে পরিষ্কার রাখা সবসময়েই খুব কঠিন ছিল, কিন্তু এটিকে চালু রাখবার জন্য একাধিক প্রচেষ্টা করা হয়েছিল।
আরও একটি পথ ছিল, এই পথ ধ’রে আরো কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর প্রথম যে জলপ্রপাতটি পড়ত সেখান থেকে বের্নিকা নামে একটি জায়গায় যেতে হ’ত। এখান থেকে আপনাকে উটে চেপে নীলনদ থেকে সমুদ্রতীরে আসতে হবে। আরেকটি পথ ছিল, এবং আরো একটি যার কথা আমি বলেছি, যা কিনা লেবানন থেকে বর্তমান ইজরায়েল হয়ে মরুভূমি এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এখনকার পেট্রাতে গিয়ে পড়ত।এইজন্যে পেট্রা এত সম্পদশালী ছিল, কারণ এটি ক্যারাভানের পথে পড়ত। তারপর এই পথ গিয়ে পড়ত আকাবা নামে একটি জায়গায়। যাই হোক, আপনি যে পথেই আসুন না কেন, আপনি লোহিত সাগরে এসে পৌঁছতেন এবং তারপর আসলে আপনাকে এই সরু, সংকীর্ণ লোহিত সাগরের দু-তীরে বাণিজ্য করতে করতে বয়ে যেতে হ’ত।আপনাকে এর মধ্যে দিয়ে বাণিজ্য করতে করতে বয়ে যেতে হ’ত।ঘটনাচক্রে ইরিথ্রিয়ান সমুদ্রের ‘ইরিথ্রিয়ান’ – এই গ্রীক শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হ’ল লাল এবং তাই আসলে এর এমন নাম হয়েছে।
যাইহোক, অতদূর আসবার পর তারা ইয়েমেনে পৌঁছত, এবং ইয়েমেন থেকে একটি নাতিদীর্ঘ যাত্রা ক’রে একটি ছোট দ্বীপে এসে পৌঁছত যার নাম সোকোত্রা। এখন প্রশ্ন হ’ল, একে সোকোত্রা বলা হয় কেন? এই নামের উৎস হচ্ছে আসলে সুখদ্বার দ্বীপ – যে দ্বীপে সুখ মেলে এবং এই দ্বীপে ভারতীয় এবং আরবদের আধিক্য ছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যস্থল ছিল, এখনও সেখানকার নানান গুহায় ভারতীয় বণিকদের এঁকে যাওয়াবিভিন্ন ধরণের দেয়ালচিত্র মেলে।এই স্থান থেকে যাবার জন্য দুটি বিকল্প পথ ছিল, এখান থেকে পুরনো রাস্তা ধ’রে উত্তরে ইয়েমেনের দিকে বালোচ উপকূল বরাবর গিয়ে গুজরাত প্রভৃতি স্থানে পৌঁছনো যেত এবং তারপর দক্ষিণদিকে যাওয়া যেত।
তবে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কোনো এক সময় হিপালুস নামের এক বুদ্ধিমান ব্যক্তি আবিষ্কার করলেন যে এইভাবে ঘুরপথে যাবার কোনো মানে হয় না, বরং আবার সেই মৌসুমী বায়ুকে কাজে লাগিয়ে জলপথে যাত্রা করে সোজা কেরালা অব্দি পৌঁছনো যেতে পারে এবং তার কিছু পরেই কেরালায় মুচিরি বা মুজিরিস নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর গড়ে ওঠে, যা বর্তমান কোচি অঞ্চলের সামান্য উত্তরে পত্তনম নামের একটি গ্রামের কাছে রয়েছে, সেখান থেকে ওই সময়কার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী পাওয়া গেছে। তাই হঠাৎ ক’রে এবং খুব নিশ্চিতভাবে আদি রোমান পর্বঅথবা তারও আগে যখন রোমান সাম্রাজ্য কেবলমাত্র একটি জনপদ ছিল সেই সময় থেকে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যের পথগুলি আবিষ্কৃত হ’তে থাকে। এটা সেই সময়কার কথা যখন ইহুদিদের মহান মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে, এসময় বেশ কিছু সংখ্যক ইহুদি এই উপকূলে এসে বসত করতে শুরু করে ইত্যাদি।
তাহলে এরা কোন্ কোন্ পণ্য দিয়ে নিজেদের মধ্যেবাণিজ্য করত? এখন, পেরিপ্লাস থেকে আমরা জানতে পারি যে ভারতীয়রা অন্যান্য জিনিস ছাড়াও তুলো – যা কিনা অত্যন্ত মহার্ঘ ছিল, বিশেষ করে গুজরাত অঞ্চলের তুলো– রপ্তানি করত। লোহা এবং ইস্পাতের সামগ্রীও রপ্তানি হ’ত, কারণ আমি আগেই বলেছি যে লোহা তো ভারতীয় উদ্ভাবন বটেই, এমনকী বহু দিন পর্যন্ত ভারতীয় ধাতুবিদ্যা খুব উচ্চমানের ব’লে গণ্য করা হ’ত। ফলে সব ধরণের ইস্পাত ও লোহার উপকরণ পাওয়া যেত এবং মুচিরি এলাকা থেকে আসা লোকেরা মশলাপাতি রপ্তানি করত, বিশেষ করে কালো মরিচ, তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আমদানি করা অনেক ধরণের মশলাও মুচিরিতে আনা হ’ত এবং তারপর ভারতীয়রা তখন সেইসব ইন্দোনেশীয় মশলাপাতিকে ভারত থেকে রোমান ও অন্যদের কাছে চালান করত। তো এই গেল ভারতীয়রা কি কি রপ্তানি করত তার কথা।
এবার তাহলে ভারতীয়রা কি কি আমদানি করত? অন্যান্য জিনিস ছাড়াও ভারতীয়রা ইতালির সুরা আমদানি করত এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে এমনটা জানা গেছে যে তারা রাজারাজড়ার হারেমের জন্য নারী আমদানি করত। অতএব এর থেকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসা যায়, সেটি হ’ল –প্রাচীন সমুদ্রযাত্রার ইতিহাস প’ড়ে আমরা জানতে পারি যে প্রাচীনকালেও প্রমোদ-সমাবেশ অনুষ্ঠানগুলিতে বিদেশি মদ ও বিদেশি গণিকা অপরিহার্য ছিল।
এখন সেই সময়ে, এত বেশি বাণিজ্যের কারণে একখানি মস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সেটা হচ্ছে এই, যদিও ভারতীয়রা প্রভূত পরিমাণে মদ ও নারী আমদানি করত, তবু তাদের রাজকোষে প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থ জমছিল। এখন, প্রাচীন যুগে উদ্বৃত্ত অর্থ নিয়ে কী করা যেতে পারে? তা দিয়ে সোনা কেনা যেতে পারে এবং রোমানরা এত লক্ষ লক্ষ সোনার মোহর রপ্তানি করছিল যে সেটা তাদের জন্য একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ এত বেশি সোনা অন্য কোনো দেশে চালান করা হ’লে নিজের দেশে মুদ্রা বানানোর জন্য যথেষ্ট সোনা থাকে না। এবং খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে রোমান সাম্রাজ্য একটি গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল, আপনারা জানেন যে সেখানকার সেনেটেপ্লিনীর মতো ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্যরা জোরদার সওয়াল করেছিলেন এই গুরুতর সমস্যাটি নিয়ে, যে তাঁদের দেশে নিজেদের মুদ্রা বানানোর জন্য যথেষ্ট সোনা নেই এবং এই ভারতীয়দের ব্যাপারে কিছু একটা করা দরকার। ফলে সম্রাট ভেস্পাসিয়ান সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি ভারতীয়দের সঙ্গে বাণিজ্যের উপর এক প্রকার নিষেধাজ্ঞাই ঘোষণা করবেন এবং প্রথমদিকে তিনি খুব চেষ্টা করলেও অবশ্যই যেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা হ’ল ভারতীয়রা এবং ইহুদিরা দুপক্ষই খুব শিগগিরি চোরাচালান করবার নানান পথ খুঁজে বের করে এবং সম্রাটের পুরো প্রচেষ্টাটাই ব্যর্থ হয়।
তাই কিছুদিন বাদে তারা আবার বাণিজ্য চালু করে, কিন্তু এবারে রোমানরা ঠিক করে যে তারা এইবার তাদের স্বর্ণমুদ্রায় সোনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা সামাল দেবে। ফলে তারা নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ণ ঘটাতে আরম্ভ করে। এবার তাহলে ভারতীয়রা এর জবাবে কী করেছিল? ভারতীয়রা ওই মুদ্রাই গ্রহণ করতে থাকে, ফলে আপনি যদি সারা ভারতে উপকূল বরাবর প্রত্নতাত্ত্বিক খননের স্থানগুলিতে যান, তাহলে আপনি প্রচুর মুদ্রা পাবেন এবং আপনি যে যুগের অঞ্চলে যাচ্ছেন সেই যুগের হিসেবে সোনার পরিমাণ কমতে থাকবে।