আজকাল অড্রে ট্রুশকের কাজের ব্যাপারে অনেক খবর শোনা যাচ্ছে, যিনি আমেরিকায় অধ্যাপনা ক’রে থাকেন এবং যিনি দাবী করেন যে ঔরঙ্গজেব একজন ভালো মানুষ ছিল, যে তার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ করা হয় সেগুলির বেশিরভাগ আসলে ঘটেইনি। ইনি একটি বৃহত্তর আন্দোলনের শরিক, যা তিন বছর আগে জুরিখে শুরু হয়েছিল। আমি সেই ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এর কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিলাম এবং সেখানে একটা গোটা অধিবেশন, একদিনব্যাপী অধিবেশন, ছিল ঔরঙ্গজেবের ব্যাপারে, হিন্দি সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে ঔরঙ্গজেবের ব্যাপারে জানবার চেষ্টা এবং প্রত্যেক বক্তা মূল যে কথাটি বারংবার আউড়ে গেলেন তা হচ্ছে অনেকেই ঔরঙ্গজেবের ব্যাপারে প্রশংসা করেছেন।
এখন, ঔরঙ্গজেবের মতো শাসকের ক্ষেত্রে এতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। আপনি চাইলেই স্তালিনের ব্যাপারে অনেক স্তুতি পাবেন, এমনকী যদি আপনি সেরকম একটাও খুঁজে না পান, তাহলেই বরং বিপদে পড়বেন। এইসব স্তুতিবাক্যের মধ্যে উদাহরণ হিসেবে গুরু গোবিন্দ সিংহের দ্বারা ঔরঙ্গজেবের ভালো চরিত্রের একটা অনুমোদন পাওয়া যায় গুরুজির বিখ্যাত রচনা জাফরনামায় – সেই বিজয়পত্র যা বিজয় খুব একটা সূচিত করে না – বরং খুব মন্থরতা এনে দেয়। দেখুন, উনি আসলে তার সাথে সখ্যতা বজায় রাখবার চেষ্টা করছেন যার হাতে সমস্ত তুরুপের তাসগুলি রয়েছে , অর্থাৎ সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সাথে যিনি তাঁকে পরাস্ত করেছিলেন। এবারে ভেবে দেখুন, এটা বোঝার জন্য আপনার বেশি কিছু জানবার প্রয়োজনও হবে না যে ব্যাপারটা স্রেফ ভাঁওতা। আসল ঘটনার ঠিক বিপরীতে এর অবস্থান, আপনারা জানেন যে পরিস্থিতির চাপে গুরু গোবিন্দ সিংহ বেকায়দায় প’ড়ে গিয়েছিলেন, ঔরঙ্গজেবের প্রতি কূটনীতি অবলম্বন করবার তাঁর কাছে যথেষ্ট কারণ ছিল হয়তো, তবে আসলে তিনি ঠিক কী মনোভাব পোষণ করতেন? এখন লোকের মনের কথা পড়তে এবং তারা ঠিক কী ভাবছে সেসব বুঝতে আমায় যথেষ্ট বেগ পেতে হয়, তবে এক্ষেত্রে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত যে তিনি পৃথিবীতে অন্য যে কারুর চেয়ে ঔরঙ্গজেবকে বেশি ঘৃণা করতেন। আমি এটা বেশ জানি। খুব নিশ্চিতভাবেই, কারণ ঔরঙ্গজেব গুরু গোবিন্দ সিংহের বাবা এবং চার ছেলেকেই হত্যা করেছিল। আমার মনে হয় না এটা বুঝতে আপনাকে মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে খুব গভীর জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে যে তিনি ঔরঙ্গজেবের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করতেন এবং এ সত্ত্বেও তর্কশাস্ত্রের অধ্যাপকেরা খুব গম্ভীরভাবে ঘোষণা করেন যে তিনি ঔরঙ্গজেবের চরিত্রের বিষয়ে প্রশস্তিমূলক বাক্য লিখে গিয়েছেন।
তবে একটা ব্যাপারে অড্রে ট্রুশকে ঠিক। এমনকী ঔরঙ্গজেবকে যারা দোষ দেয় সেই সমস্ত হিন্দুরা ভাবে যে সে একটা শয়তান লোক ছিল, এরা একটা একপেশে ধারণা পোষণ করে। ঔরঙ্গজেব একটি আদ্যন্ত ভালো লোক ছিল, অন্ততঃ যদি আপনি মনে করেন যে ধর্মভীরু হওয়াটা একটা সদ্গুণ। সে একজন অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ এস্কিমো ছিল এবং সে খুবই শুদ্ধাচারী ব্যক্তি ছিল, যে জন্য সে তার পিতা শাহজাহানকে একটি অত্যন্ত সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটানোর কারণে ঘৃণা করতো, রাজস্ব এবং রাজস্ব থেকে আদায় করা অর্থ তাজমহলের মতো ফালতু ব্যাপারে নষ্ট করবার কারণেও, এবং এ কারণেও যে তার পিতা হিন্দুদের অপদস্থ করার কাজটিতে মিতব্যয়ী ছিলেন। হ্যাঁ, এই দিক দিয়ে দেখতে গেলে সে একজন আদর্শ চরিত্র ছিল। এখন যে মতাদর্শের কারণে সে শুদ্ধাচারী জীবনযাপন করতো, সেই একই মতাদর্শের কারণে সে পাইকারি হারে মন্দির এবং মূর্তি ধ্বংস করেছিল, সেই একই কারণে সে বিধর্মীদের উপর জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন করেছিল। জিজিয়া হচ্ছে একটি বিশেষ কর, যা কেবল অ-এস্কিমোদের দিতে হ’ত স্রেফ টিঁকে থাকবার অনুমতি পাবার জন্য। যেহেতু সে খুবই ধর্মভীরু লোক ছিল, তাই সে খুবই শুদ্ধাচারী ছিল, এবং যেহেতু সে খুব ধর্মভীরু ছিল তাই সে অসংখ্য মন্দির ধ্বংস করেছিল। তাই যদি আপনি মনে করেন যে ধর্মভীরুতা একটি সদ্গুণ, তাহলে ঔরঙ্গজেব সত্যিই খুব ভালো লোক। দুর্ভাগ্য এই যে, যে ধর্মের প্রতি তার নিষ্ঠা ছিল, সেই ধর্মেই কিছু গলদ রয়েছে।
যাই হোক, সাধারণভাবে বলতে গেলে, যখন রাজনৈতিক অবস্থা অনুকূল নয়, তখন সেই লোকেরাই এস্কিমোদের ব্যাপারে ভাল ভাল কথা বলতে বাধ্য হন যাঁরা জানেন যে ব্যাপারটা আসলে কি। যখন সেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাগুলি সরে যায়, তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ইতিহাসবিদদের ভেবে বের করা নানান হাস্যকর পণ্ডিতি কারসাজিতে চারদিকে হাসির রোল ওঠে।